মানসিক রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা



মানসিক রোগ কাকে বলে?

আমরা জীবনের কোনো না কোনো সময় বিভিন্ন কারণে ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। কখনো দুঃখ পাই , কখনো বা রাগ প্রকাশ করি; যখন এই উপসর্গগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাধার সৃষ্টি করে। এগুলোকে বলা হয় মানসিক রোগ।


কখন মানসিক রোগী বলা হয়?

১ . যদি কারো চিন্তার পরিবর্তন, আবেগের পরিবর্তন, স্মৃতিশক্তির পরিবর্তন, বিচার বিবেচনা বা বোঝার পরিবর্তন হয় এবং তা তার কথাবার্তা বা আচার - আচরণে প্রকাশ পায়, তাহলে তাকে মানসিক রোগে আক্রান্ত বলে মনে করা হয়।


২ . তাদের ব্যবহারিক পরিবর্তন, তাতে যদি আশপাশের লোক কষ্ট পায় বা আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে কষ্ট পায়।


৩. তার আচার - আচরণের পরিবর্তনের ফলে যদি তার দৈনন্দিন কাজ - কর্মের ব্যাঘাত ঘটে, কাজের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়। আহার, নিদ্রার পরিবর্তন হয়। লোকজনের সাথে মেলামেশায় ব্যাঘাত ঘটায় অর্থাৎ এক কথায় সামাজিক ও পেশাগত ক্ষতিসাধন করে, তবে তাকে মানসিক রোগের লক্ষণ বলে ধরা হয়।


মানসিক রোগের লক্ষণসমূহ

মানসিক রোগের লক্ষণ কোনোরূপ প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা বা এক্স - রে করে এটিকে ধরা যায় না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ রোগীর আচার - ব্যবহার ও রোগীর বর্ণিত বিভিন্ন উপসর্গ দ্বারা মানসিক রোগকে চিহ্নিত করতে পারেন। যে চিকিৎসক যত বেশি অভিজ্ঞ; তিনি তত সহজে সঠিকভাবে রোগটি নির্ণয় করতে পারেন।


নিচে কতগুলো উপসর্গের বর্ণনা দেয়া হলো

আমরা মানসিক রোগ নির্ধারণ করি রোগীর ব্যবহার, আচার - আচরণ দেখে। কিন্তু রোগীর শারীরিক পরীক্ষা - নিরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের ল্যাবরেটরি পরীক্ষাও আমাদের করে নিতে হয়। তবে তার পরিমাণ যৎসামান্য।


জটিল মানসিক রোগী নিজে যেমন কষ্ট পায়, সমাজের আরো অনেককে সে কষ্ট দিয়ে থাকে তার আচার - আচরণ বা ব্যবহারের মাধ্যমে। ফলে জটিল মানসিক রোগীদের নিকট আত্মীয়রা সহজেই বুঝতে পারে যে, সে মানসিক সমস্যায় ভুগছে।


অপর দিকে যিনি মৃদু মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত, তার কষ্ট অন্য লোক বা অনেক সময় নিকট আত্মীয়রাও বুঝতে পারেন না। সে নিজে কষ্ট পায় কিন্তু অন্যকে কষ্ট দেয় না। যেমন মন খারাপ; এই উপসর্গের কোনো ল্যাবরেটরির মাপকাঠি নেই, তাই একে যাচাই করতে হয় রোগীর কষ্ট ও চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা দ্বারা।


মৃদু মাত্রার মানসিক রোগ, ঘুণে ধরা বা কুঁরে কুঁরে খাওয়ার মতো। পৃথিবীর যে কোনো জনগোষ্ঠীর শতকরা ৩০ ভাগ মৃদু মানসিক রোগে আক্রান্ত। সকলের বোঝার জন্যে মানসিক রোগের কিছু উপসর্গের কথা এখানে লেখা হল।


অতি উত্তেজনা, অতিরিক্ত রাগ, অত্যধিক আত্মপ্রত্যয়, চঞ্চলতা, অন্তর্দৃষ্টি খুলে যাওয়া, প্রলাপ বকা, জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা, বিক্ষুব্ধ বা আক্রমণাত্মক আচরণ, ঘন ঘন কথা বলা, অল্প কথায় উত্তর দেয়া, অনিয়মিত আহার, অনিদ্রা, পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন না থাকা, জীবনবোধ সম্বন্ধে হতাশা, অকারণে হাসা, অনর্থক বিড় বিড় করে কথা বলা, এলোমেলো কথা বলা, কথার খেই হারিয়ে ফেলা।


সর্বক্ষণ বিষণ্ন থাকা, কোনো কিছু ভালো না লাগা, অস্থিরতা, অতিরিক্ত ধীর হয়ে যাওয়া, অরুচি, কাজে মন না বসা, শরীরের বিভিন্ন স্থানে জ্বালাপোড়া, মাথাব্যথা, অসহায়বোধ, হতাশাবোধ, আত্মনির্ভরশীলহীনতা, নিজেকে ছোট ভাবা, শারীরিক কোন কারণ ছাড়া ঘন ঘন প্রস্রাব করা, শারীরিক কোন কারণ ছাড়া ওজন কমে যাওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা করা।


শারীরিক কোনো কারণ ছাড়া বুক ধড়ফড় করা, দম বন্ধ হওয়া, বুকে ব্যথা, গলা শুকিয়ে যাওয়া, ঘন ঘন ঢোঁক গেলা, ঢোঁক গিলতে কষ্ট হওয়া, মাথার চারদিকে চাপবোধ হওয়া বা টেনশন করা, অরুচি, অকারণে ভীতি, মৃত্যুভীতি, ঢেঁকুর তোলা, হাত - পা কাঁপা, ঠিকমতো ঘুম না হওয়া, অতিচিন্তা, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, পড়া মনে না থাকা, খেলেই পায়খানার বেগ হওয়া।


যৌনভীতি, পুরুষাঙ্গ সম্বন্ধে হতাশা, হীনবোধ, নিজেকে অক্ষম মনে করা, অশান্তিময় যৌনমিলন, স্ত্রী অঙ্গে ব্যথা বা কোমরে ব্যথা, লিঙ্গ সম্বন্ধে অযথা চিন্তা করা, যৌনাঙ্গ ছোট বা কম জোর মনে করা, বিবাহভীতি, যৌনমিলনে স্ত্রী বা স্বামীর অনিচ্ছা।


অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন মত বদলানো, বিশ্বাসহীনতা, সন্দেহমূলক দৃষ্টিপাত, সন্দেহ করা, বাতিকগ্রস্ততা, উগ্রতা, ভুল বকা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, লোক চিনতে ভুল করা, সামঞ্জস্যহীন কথা বলা, নিজের সাথে নিজে কথা বলা, গায়েবি আওয়াজ শোনা, ক্লান্তি, একঘেয়েমি, অদৃশ্য শত্রুভীতি।


ছেলে - মেয়ে বা স্বামী - স্ত্রীর প্রতি বিরক্তি, নিজেকে দোষী ভাবা, নিজের জন্যে অন্যের কষ্ট হচ্ছে মনে করা, অস্থিরতা, খাদ্য হজম না হওয়া, ফাঁসি দিতে ইচ্ছা করে, আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, মাথা বা শরীর গরম লাগা, শরীর দুর্বল, শরীর ঘামে ভিজে যাওয়া, অন্যের জিনিস নিয়ে নিতে ইচ্ছা করা।


শেষ রাতে ঘুম ভাঙা, কথা কম বলা, বিভিন্ন জিনিস / বস্তুর ভয় লাগে, বুকে চাপ দেয়, শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করে, নার্ভাস লাগে, অল্প আওয়াজে বিরক্ত লাগে, রাস্তা দিয়ে হাঁটলে লোকজন তাকিয়ে থাকে মনে হওয়া, অন্য কথা বললে মনে হয় আমাকে নিয়ে কথা বলছে, অশুচি লাগে, নোংরা লাগে, খুঁতখুঁতে স্বভাব।


বদমেজাজ, বহির্মুখী, ক্ষণে ভালো ক্ষণে মন্দ, স্মৃতিভ্রম, উদাসীন, আবেগপ্রবণ, ঘুম না হওয়া, বোকা প্রকৃতির, জ্ঞান - বুদ্ধি কম, সাধারণ কাজ শিখতে না পারা, ভালো - মন্দ জ্ঞানের অভাব, অল্পতেই খিঁচুনি হওয়া, অবসাদ ভাব, বাড়ির ঠিকানা মনে না করতে পারা, কোথায় আছে কী খেল বলতে না পারা, লোকজন চিনতে না পারা।


মানসিক রোগের প্রকারভেদ

প্রকোপ অনুযায়ী মানসিক রোগকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়।

1. একটি জটিল এবং

2. অপরটি লঘু বা মৃদু 


জটিল ব্যাধিগুলোকে সাইকোসিস এবং লঘু ব্যাধিগুলোকে নিউরোসিস বলা হয়।


নিউরোসিস রোগে রোগীর নিজের কষ্ট বেশি হয় এবং তার রোগ সম্বন্ধে একটি জ্ঞান থাকে। শুরু ব্যাধিগুলোকে রোগীর কষ্টের পাশাপাশি তার আত্মীয় স্বজন ও পরিবার - পরিজনের কষ্ট বেশি হয় এবং রোগী যে মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে তা সে অস্বীকার করে।


মৃদু মানসিক রোগ

১. টেনশন 

২. ফোবিয়া বা অহেতুক ভীতি 

৩ , অবসেশন বা শুচিবায়ু 

৪. হিস্টিরিয়া ও ভর করা 

৫. ধাতুগত রোগ


জটিল মানসিক রোগ

১. সিজোফ্লেনিয়া 

২. ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা 

৩. ম্যানিয়া 

8. গর্ভকালীন বা গর্ভ - পরবর্তী মানসিক রোগ


শিশু - কিশোরদের মানসিক রোগ

১. বিছানায় মল - মূত্র ত্যাগ 

২. স্কুল পালানো / স্কুলভীতি 

৩. আচরণগত সমস্যা 

৪. চঞ্চলতা 

৫. ক্ষুধামন্দা / খাবারের প্রতি ইচ্ছা


অন্যান্য মানসিক রোগ

১. মাদকাসক্তি 

২. মৃগীরোগ ও মৃগীজনিত মানসিক রোগ 

৩. মানসিক প্রতিবন্ধী


চিকিৎসা

কিছু কিছু মানুষের সমস্যার ক্ষেত্রে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয় , কিছু কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে ওষুধ ছাড়াই বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায় । আবার, কোন কোন ক্ষেত্রে ওষুধ এবং থেরাপি উভয়টির প্রয়োজন হয়।


চিকিৎসার জন্য আপনার নিকটস্থ সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে যোগাযোগ করতে পারেন।


লেখক: ডা. মোঃ ফাইজুল হক

Post a Comment

Previous Post Next Post