ক্রিপটোমেনোরিয়া মাসিক যেথা লুকিয়ে রয়



রামিসা, চৌদ্দ বছরের টলটলে কিশোরী। ক্লাস নাইনে পড়ে। হাত পা বড় হয়ে গেছি, বড় হয়ে গেছি একটা বার্তা দিলেও চোখমুখে শিশুসুলভ একটা লাবন্যের প্রলেপ ঠিকই লেগে আছে। দেখলে মনে হয় হঠাৎ বড় হয়ে যাওয়ার আগমনী বার্তায় বেচারা একটু দিশেহারা যেনো। পড়াশোনায় ভালো, বলে বাড়তি একটা মনোযোগ সে পায়, কি স্কুলে, কি বাড়িতে। খেলাধূলা, গান কবিতা, স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব জায়গায় তার একটা অবধারিত উপস্থিতি থাকবেই। দিনমজুর বাবার সংসারে অর্থনৈতিক টানাটানি থাকলেও সন্তানের ঔজ্জ্বল্যে তা চাপা পড়ে যায়। মা বাবার ওকে নিয়ে সন্তুষ্টির শেষ নেই। তুই মানুষের মতো মানুষ হ, এটাই চাইরে মা, বাবা এটা বল্লেও মেয়ে যে পড়াশোনা করে বাবার সংসারের হাল ধরবে এতে কোন সন্দেহ নেই।


এমনি করে একটি একটি করে মধ্যবিত্ত দিন অতিবাহিত হতে লাগল। হঠাৎ একদিন রামিসার পেটে ব্যাথা শুরু হলো, সাথে পেটে ভয়াবহ প্রস্রাবের চাপ কিন্তু কিছুতেই প্রস্রাব করতে পারছে না। মেয়ের চোখ দিয়ে দরদরিয়ে পানি পড়ছে, প্রানপনে কান্না চেপে রাখতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। পারা সম্ভব না। ভয়াবহ প্রসাবের বেগ হচ্ছে, ওয়াশরুমে গেছেনও কিন্তু ভয়েড করতে পারছেন না, এর ব্যাথার তীব্রতা আমি কিভাবে বর্ণনা করি! সে সাধ্য কী আমার লেখা শব্দের আছে? বৃথা সে চেষ্টা করলাম না, ভুক্তভোগী ছাড়া এটার কষ্ট বোঝা অসম্ভব।


রামিসাকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ক্যাথাটার দিয়ে প্রসাব করানো হলো। প্রায় দুই লিটার! ব্লাডার যে ফেটে যায়নি এটাই ভাগ্য।


কেনো এমন হলো আফা আমার মেয়ের? বলেই চোখ মুছলেন রামিসার মা।


তার আগে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন তো মা। রামিসার আর কখনো এমন ব্যাথা হয়েছে?


প্রতি মাসেই একটা নির্দিষ্ট সময়ে অল্প অল্প ব্যাথা হতো, থাকত চার পাঁচ দিন।


কত দিন থেকে?


দুই তিন বছর তো হইবোই। মাইয়া আমার অনেক লক্ষ্মী, দাঁতে দাঁত চাইপ্পা সহ্য করছে। কাউরে কয় নাই। আমি গ্যাস্টিকের ব্যাথা মনে কইরা ওষুধ খাওয়াছি, কিন্তু কোন লাভ হয় নাই আফা।


আরেকটি কথা বলেন তো, মেয়ের মাসিক শুরু হয়েছে?


না, ওর লগের সব মাইয়াগো হইসে, কিন্তু ওর এখনো হয় নাই।


কোন ডাক্তার দেখিয়েছেন?


না আফা, মনে করছি মাইয়ার সব ঠিক আছে, হয় তো একটু দেরী কইরা হইব। আফা আমার মাইয়ার কী কোন বড় সমস্যা?


হুম, একটু সমস্যা তো আছেই। রামিসার আসলে মাসিক হয়, কিন্তু মাসিকের রক্ত বাইরে আসে না। সত্যি কথা বলতে কি, রামিসার মাসিকের রক্ত বাইরে আসার পথ জন্মগত ভাবে বন্ধ। ফলে ভিতরেই জমা হয়। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে বলে ক্রিপ্টোমেনোরিয়া অর্থাৎ লুকিয়ে থাকা মাসিক। আর তার থেকেই যত সমস্যার শুরু হয়। যেমনটা রামিসার হয়েছে।


এই কথা শুনে মা বিলাপ করে কান্না জুড়ে দিলেন। আল্লাহ গো আমার রামিসার কী হবে গো...হাহাকারে পুরো হাসপাতাল ভারী হয়ে ওঠে।


আসুন তো জানি রামিসার কেনো এমন হলো।

মেয়েদের জননাঙ্গ মানে জরায়ু, টিউব, যোনী মুলারিয়ান ডাক্ট নামক একটা জিনিস থেকে তৈরী হয়। কোন কারনে এটা ঠিকঠাক তৈরী না হলে উপরোল্লিখিত অঙ্গগুলো তৈরী হয় না। আবার কখনো কখনো অসম্পূর্ণ তৈরী হয়। যেমন জরায়ু হলো, কিন্তু যোনী পথ হলো না। কিংবা অর্ধেকটা হলো, অথবা সবটাই হলো কিন্তু শুধু জন্মপথটার মুখটা একটা পর্দা দিয়ে পুরোপুরি বন্ধ থাকল। ফলে মাসিকের রক্ত মাসে মাসে জন্মপথে তারপর জরায়ুতে জমা হয়, এটা ভরে গেলে টিউবে, টিউব হয়ে পেটে। এমনটা হলে জরায়ুর ফাংশন তো নষ্ট হয়ই, পেটের নাড়িভুঁড়ি ও জরায়ুর সাথে এডহেসান হয়ে একসাথে তালগোল পাকিয়ে যায়। রক্ত জমা হতে হতে টিউমারের আকার ধারণ করে, প্রসাবের নালীকে চাপ দিয়ে লম্বাটে এবং বন্ধ করে দেয়, ফলে রিটেনশান ওব ইউরিন হয়, যেটা রামিসার হয়েছে।


তবে যদি শুধু জরায়ু থাকে এবং আর কিছু না থাকে, কনজারভেটিভ চিকিৎসা ফেইল করলে অনেক সময় শেষ চিকিৎসা হিসাবে জরায়ু কেটে ফেলা লাগতে পারে। এমনটা বছর দুয়েক আগে পরীর মতো ফুটফুটে এক মেয়ের ক্ষেত্রে করতে হয়েছিল। দুই দুইবার অপারেশন করে মাসিকের পথ তৈরীর চেষ্টাকে মিথ্যা করে দিয়ে আবারো যখন এমনটা হলো তখন পরীর মা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো, বাঁচলে তো বাচ্চাকাচ্চা, আমার মাইয়ারে আগে বাঁচান ডাক্তার আপা।


তবে রামিসার ভাগ্য মন্দের ভালো। ওর সবই ঠিকঠাক আছে শুধু জন্মপথটা মুখের কাছে একটা পর্দা দিয়ে বন্ধ। যেটাকে ডাক্তারী ভাষায় বলে ইম্পারফোরেটেড হাইমেন। এক্ষেত্রে অপারেশন করে পর্দাটা সরিয়ে দিলে জমা হওয়া রক্ত গলগল করে বের হয়ে আসবে। কোন মতেই পেটে চাপ দেয়া কিংবা ইন্টারনাল এক্সামিন করা যাবে না। এন্টিবায়োটিক দিতে হবে, ফলোআপ করতে হবে। জরায়ুর লাইনিং এন্ডোমেট্রিয়াম যদি নষ্ট না হয়ে যায়, টিউব যদি ভালো থাকে পরবর্তীতে ওর বাচ্চাকাচ্চা হতে সমস্যা হবে না আশাকরি। রামিসা ওর এই জন্মগত ত্রুটিতে প্রথমে একটু হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো। পরে ছোট ছোট প্রশ্ন করে যখন জানল এটাতে ওর কোন হাত নেই সবই প্রকৃতির খেয়াল তখন মেনে নিল। রামিসাকে খুব সহমর্মিতার সাথে বল্লাম,


দেখো যেখানে মানুষের জন্মেই তার কোন হাত থাকে না, সেখানে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে আক্ষেপ করা কোন কাজের কথা না। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে যেমন চেয়েছেন তেমন সৃষ্টি করেছেন, এটা নিয়ে আক্ষেপ করো না। মানুষের জন্ম শুধু মাসিক হওয়া, সন্তান জন্মদানের জন্য না। এরচেয়ে বড় আরো অনেক কাজ আছে। তুমি পড়াশোনা করে স্বাবলম্বী হতে পারো, পরিবারের জন্য কিছু করতে পারো, সমাজের জন্য কিছু করতে পারো দেশের জন্য কিছু করতে পারো। দোয়া করি তুমি যেনো এটাকে সহজ ভাবে নিতে পারো, পড়াশোনা করে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে পারো। তোমার মতো এমন কারো জন্য কিছু করতে পারো। বলতে বলতে দেখলাম রামিসার চোখ টলমল করে ওঠল। পরক্ষনেই সামলে নিল, এক চিলতে হাসির রেখা ঠোঁটে। বলল,


ম্যাডাম, আমি এটা নিয়ে একদম মন খারাপ করব না, এবং অবশ্যই পড়াশোনা শেষ করব, স্বাবলম্বী হবো। আমাকে নিয়ে আমার বাবা মা কে দুশ্চিন্তা করতে দিব না।


আরো কী কী যেনো বলছিল। আমি সেসব ছাপিয়ে মেয়েটার মাথায় আলতো করে হাত রাখলাম। মনে মনে বল্লাম, যাক কাউন্সেলিং এ কাজ হয়েছে। মানুষ যেমনই হোক তার নিজের অবস্থানে সন্তুষ্টি থাকা বিশাল ব্যাপার। সেই বিরল ব্যাপারটিই এইমাত্র প্রত্যক্ষ করলাম। আলহামদুলিল্লাহ।


ডা. ছাবিকুন নাহার

মেডিকেল অফিসার 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

Post a Comment

Previous Post Next Post