বাচ্চার জেদকে প্রশ্রয় দেবেন না


তিন্নি খুব ফুটফুটে একটি মেয়ে। সারাদিন প্রজাপতির মতন হেসেখেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছু যদি আবদার করে না পায় তাহলে তার অন্যরূপ দেখে বাড়ীর সদস্যরা। এই তো সেদিন তিন্নির বাবা ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলেন।


হঠাৎ তিন্নি বায়না করল সেও ল্যাপটপে বসে ছবি আঁকবে। তার বাবা সে ব্যাপারে একমত না হতেই তিন্নি চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। তারপর মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকল। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষপর্যন্ত তার বাবা নিজের কাজ ফেলে তাকে ল্যাপটপ ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে শান্ত করল তাকে।


পরের ঘটনাটি সাগ্নিকের। ক্লাস ওয়ানে পড়া সাগ্নিক কোনো কিছু মুখ থেকে খসানোর আগেই হাতের মুঠোয় পেয়ে যায় সব। সাগ্নিকের মায়ের এ ব্যাপারে আপত্তি থাকা সত্বেও বাড়ীর বাকী সদস্যদের প্রশ্রয়ে তা ধোপে টেকে না। উত্তোরত্তর জেদের রকমফের বাড়ছে তার। মাকে সে মনে করছে তার পরম শত্রু। প্রয়োজনে মায়ের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করছেনা সে।

ওপরের দুটি ঘটনা আমাদের অতি পরিচিত দৃশ্য। জেদ বা টেম্পার ট্যানট্রাম বাচ্চাদের মধ্যে খুবই সাধারন। কিন্তু একে প্রশ্রয় দেওয়া মানে ওর আগামী দিনগুলোয় বিপদ ডেকে আনা।


কেন হয় টেম্পার ট্যানট্রাম বা জেদ?

বাচ্চারা তাদের নিজস্ব হতাশা, ক্ষোভ বা চাহিদা প্রকাশ করে জেদ বা ট্যানট্রামের মাধ্যমে। আমরা বড়রা যেভাবে নিজেদের এইসব অনুভুতিগুলোকে আত্মসংবরন বা সেল্ফ কনট্রোল করতে পারি বাচ্চারা তা মোটেই পারেনা। তার ফলে তাদের আচরণে বাহ্যিক হতাশার প্রকাশ এভাবেই ঘটে। তিন থেকে সাত বছরের মধ্যে টেম্পার ট্যানট্রাম সবচেয়ে বেশী আত্মপ্রকাশ পায়। এই সময়ে যদি সঠিকভাবে বাচ্চাদের চালিত করা না যায় তাহলে আগামী দিনে এদের ব্যবহারের মধ্যে অনেক নেগেটিভ কোয়ালিটি জন্ম নেয়। যা বাচ্চা ও তার পরিবারের ক্ষেত্রে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়।


বয়স অনুযায়ী জেদের নমুনা

বিভিন্ন ধরণের সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষন করে দেখা গেছে বিভিন্ন বয়সে বাচ্চাদের জেদের বহি:প্রকাশ বিভিন্নভাবে হয়। তার একটা ধারণা আপনাদের দিই।


জন্ম থেকে দু বছর পর্যন্ত:

এই সময়ে বাচ্চা নিজের জেদের বহি:প্রকাশ মোটামুটি কান্নার মধ্যেই সীমিত রাখে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাচ্চার খাওয়া, ঘুম পর্যাপ্ত না হলে এই ধরণের জেদ করে থাকে। টয়লেট সংক্রান্ত অস্বস্তিও এর আর একটা বড় কারণ। এছাড়া বিভিন্ন শারীরিক অসুবিধার সৃষ্টি হলেও কথায় না বলে কান্নাকাটির মাধ্যমে তারা তা প্রকাশ করার চেষ্টা করে।


দু বছর থেকে চার বছর:

এই সময় বাচ্চার অন্যান্য অভিব্যক্তির সাথে সাথে বাচ্চার ইমোশনাল দিকটারও বিকাশ হয়। তার ফলে জেদের প্রকাশও বিভিন্ন রকমভাবে পাওয়া যায়। কোনো জিনিস চেয়ে ব্যর্থ হলে বাচ্চা কখনো চিৎকার করে, মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খায়, অনেক সময় মা বাবাকে আঘাত করে বা নিজেদের আঘাত করে। কখনো লাথি মারা বা থুতু দেওয়া,জিনিপত্র ছুঁড়ে ফেলা, বই ছিঁড়ে ফেলা, কামড়ে দেওয়া এসব উপসর্গও দেখা যায় জেদের বহি:প্রকাশ হিসেবে।


চার থেকে সাত বছর:

এই সময় বাচ্চা প্রিস্কুলের বয়স পেরিয়ে জুনিয়ার গ্রুপে পড়ে। আগেকার জেদ যদি ঠিকঠাক সামলান না যায় তাহলে এই বয়সে বাচ্চারা স্বচ্ছন্দে তাদের জেদের আত্মপ্রকাশ করে নিজেদের পছন্দমতন উপায়ে। মা বাবারা বা পরিবারের বাকী সদস্যরা অতিষ্ট হয়ে ওঠেন এদের বাড়াবাড়িতে। মা বাবার সাথে উচ্চস্বরে ঝগড়া করা, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া, খাবার খেতে না চাওয়া এই সব অভ্যাসও যুক্ত হয় এদের ব্যবহারে।


কিভাবে সামলাবেন জেদ বা টেম্পার ট্যানট্রাম?

বাচ্চার জেদ সামলানোর প্রাথমিক উপায় নিজেদের মনকে শান্ত রাখা। তার জন্য দরকার উপযুক্ত প্ল্যানিং। প্রথম থেকেই যদি ওদের জেদ জনিত ব্যবহারে লাগাম দেওয়া যায়, বাচ্চাদের চারিত্রিক কাঠামোর অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় গোড়ার থেকেই।


১। নিজেকে স্থিতিশীল রাখুন, উত্তেজিত হবেন না:

যখনই বাচ্চারা জেদ করা শুরু করবে মা বাবা ও পরিবারের সবাইকে খুব শান্ত ও সংঘবদ্ধ থাকতে হবে। যদি বাড়ীর লোকের মধ্যে মতের অমিল হয় তার জেদের কারণ নিয়ে, তবুও কোনোভাবেই বাচ্চার সামনে তা প্রকাশ করা চলবেনা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাড়ীর গুরুজনেরা ওদের এই জেদের অভিব্যক্তি মেনে নিতে পারেন না এবং স্নেহবশত: তাদের দাবী করা জিনিসটি তাঁরা দিয়ে দেন। এটা একেবারেই ভুল পদক্ষেপ। বাচ্চারা খুব সহজেই পরিবারের মেরুকরন বুঝতে পারে এবং সেই পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে।


২। নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখুন:

বাড়ীর মধ্যে জেদের সুত্রপাত হলে বাচ্চাকে কিছু খেলনা দিয়ে আলাদা করে বসিয়ে রাখুন।লক্ষ্য রাখবেন জায়গাটি যেন সুরক্ষিত থাকে কারণ এই সময় বাচ্চারা বিক্ষুব্ধ অবস্থায় থাকে। নিজেরা শান্ত ও গম্ভীর থাকুন। খুব প্রয়োজনভিত্তিক কথা ছাড়া কোনোভাবেই কোনো অতিরিক্ত কথা বলবেন না। মারধোর বা বকাবকি করাও একদম নয় এই সময়ে। এই সময়ে কোনোভাবেই বাচ্চার সাথে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন না। বাচ্চার ব্যবহারকে কোনোরকম গুরুত্ব দেবার চেষ্টাও করবেন না। অ্যাটেনশন না পেলে ওদের মধ্যে শান্ত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। একে বলে ট্যানট্রাম সাবসাইডিং।


৩। ধীরে ধীরে ট্যানট্রাম বা জেদ যখন কমে আসে সেই সময়টা পেরেন্টিং র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। সেই সময় বাচ্চাকে স্নেহের সাথে বোঝাতে হবে সে যা ব্যবহার করছে তা পরিবারের কারোর কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি সে আবার ওরকম ব্যবহার করে আবার তাকে বাড়ীর সবার নির্লিপ্ত ব্যবহার পেতে হবে। তার নিজস্ব চাহিদা নিশ্চয় থাকতে পারে, কিন্তু তা প্রকাশ করতে হবে সংযতভাবে। এইভাবে তার মধ্যে সেল্ফ কন্ট্রোল বোধ তৈরী হবে।


৪। বাড়ীর বাইরে বাচ্চারা অনেকসময় জেদের বহি:প্রকাশ ঘটায়। এখনকার বাচ্চাদের গন্তব্যস্থল বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শপিং মল। সেখানে সার সার সুন্দর করে সাজানো খেলনাপাতির সামনে নি:সন্দেহে তাদের চাহিদার পরিমান হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। ফলে উদ্দিষ্ট জিনিসটি পাওয়ার জন্য ট্যানট্রাম শুরু করে তারা। এক্ষেত্রে দুটি সমাধান আছে। প্রথমত: শপিং মল জাতীয় জায়গায় বাচ্চাদের যতটা কম নিয়ে যাওয়া যায় ততই ভালো। বাচ্চাদের রিক্রিয়েশন খেলার মাঠ হতে পারে কিন্তু শপিং মল নয়। যদি একান্তই নিয়ে যেতে হয় বাড়ীতে তাকে বার বার কাউন্সেলিং করে নিয়ে যাওয়া উচিত।


এ বিষয়ে একটা ছোট্ট ঘটনা বলি আপনাদের। পাঁচ বছরের জোজো তার বাবার সাথে অ্যামিউজমেন্ট পার্কে যাবার প্ল্যান করেছে। তার বাবা তার জন্য কিছু শর্ত দিলেন। অ্যামিউজমেন্ট পার্কে গিয়ে তিনবারের বেশী কিছু আবদার করা চলবে তার বেশী আব্দার করলে তাকে পার্ক থেকে ফিরিয়ে আনা হবে। পার্কে গিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই জোজোর তিনটে আব্দার পূরণ হয়ে গেল। এবার চতুর্থ আব্দারের জেদ শুরু করা মাত্রই তার বাবা তাকে তাদের শর্তের কথা মনে করিয়ে দিলেন। তা সত্বেও সে যখন জেদ অব্যাহত রাখল তার বাবা একটুও বকাবকি না করে বা উত্তেজিত না হয়ে তাকে নিয়ে তৎক্ষনাৎ পার্ক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এল। বাবার এই আকস্মিক ব্যবহারে জোজো কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও বুঝতে পারল সে তার শর্ত রাখেনি বলেই তাকে এই ফলভোগ করতে হল। বলাইবাহুল্য জোজো বাইরে বেড়াতে গিয়ে আর কখনো শর্তভঙ্গ করেনি।


৫। যেসব মায়েরা কর্মরত তাদের অনেকসময় একটা অকারণ অপরাধবোধ কাজ করে। তাদের সবসময়ই মনে হয়, বাচ্চাকে সে অযত্ন করছে। তাই কাজ থেকে বাড়ী ফেরার সময় প্রায়ই বাচ্চাদের জন্য চকোলেট, চিপস বা খেলনাপাতি নিয়ে বাড়ীতে ঢোকেন। এতে স্বভাবতই বাচ্চার মনে চাহিদার মাত্রা বাড়ে। এই ধরণের ‘পেরেন্টিং ব্রাইবিং’ বাচ্চাদের জেদ বা ট্যানট্রামের অন্যতম কারণ।


বাচ্চাকে সহজভাবে বোঝান আপনার বাইরে কাজ করাটা প্রয়োজন। বাচ্চার এক্সপেক্টেশন ম্যানেজ করুন যতটা সম্ভব। দেখবেন ও অনেক সহজভাবে বড় হচ্ছে। বাড়ী ফিরতে দেরী হলে চকোলেট নিয়ে বাড়ীতে আসার প্রয়োজন নেই বরং ফিরতে ফিরতে ফোনে ওর সাথে প্ল্যান করে ঠিক করুন আজ রাত্তিরে কি গল্প বলবেন ওকে। দেখবেন জেদ উধাও হয়ে অনেক বেশী উৎসুকভাবে ও অপেক্ষা করছে আপনার।


৬। বাচ্চার মধ্যে জেদ সংবরণের প্রবণতা দেখলে প্রশংসা করুন। আপনার প্রশংসা আপনার বাচ্চাকে উৎসাহিত করবে সেল্ফ কন্ট্রোল শেখাতে।


বাচ্চার জেদ বা ট্যানট্রাম সামলানোর জন্য মারধোর বা বকাবকির প্রয়োজন হয়না। দরকার কেবল আপনার ধৈর্য বা পেশেন্স, উপযুক্ত প্ল্যানিং, বাড়ীর সব সদস্যদের বাচ্চাদের প্রতি একই ধরণের ব্যবহার আর পজিটিভ বা অথরিটেটিভ পেরেন্টিং পদ্ধতি।

Post a Comment

Previous Post Next Post