বাবা মেয়ের গল্প



একরাতে ঘুমাতে যাবার আগে হঠাৎ আমার মেয়ে-দুটোকে খুব অদ্ভুত আর খুব কষ্টকর একটা প্রশ্ন করেছিলাম। আমি জানি শিশু মনে এতো কঠিন চাপ সৃষ্টি করা ঠিক নয়, একদম ঠিক নয়। তাও কেনো জানি সেদিন নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারছিলাম না। আমার হঠাৎ মনে হলো, আমার মেয়ে-দুটোকে প্রশ্নটা করতেই হবে। যদিও পরীক্ষা নেবার মতো যথেষ্ট বয়সও হয়েছিলো না। ভালো কথা, ঘটনাটি ইংরেজি ২০১২ সনের। মানে তখন ওদের দু'জনের বয়স মাত্র ৭ বছর।

ঘুমাতে যাবো, এমন সময় সেই কষ্টকর প্রশ্নটা করলাম:

- আচ্ছা আম্মুরা। একটা প্রশ্ন করবো, আমি খুব দ্রুত উত্তর চাই তোমাদের দুজনের কাছ থেকেই। ঠিক আছে?

- ঠিক আছে বাপু। (ওদের facial expression এবং body language-এ মনে হচ্ছিল ওরা ধরে নিয়েছে আমি খুব মজার একটা প্রশ্ন করবো, ধাঁধা ধরনের।)

- মনে রেখো, খুব দ্রুত উত্তর দিতে হবে। সময় নিয়ে চিন্তা করে উত্তর দেয়া যাবে না। আমি প্রশ্ন করবো, সাথে সাথে উত্তর দিবা, ঠিক আছে?

- ঠিক আছে বাপু।

- ধরে নাও তোমরা দুজন বড় হয়ে দেশের বিচার কাজের দায়িত্ব পেলে। আর ধরে নাও, যেভাবে বিচার করা উচিত, সেভাবেই তোমরা বিচার করতে পারছো।

- ঠিক আছে বাপু, ধরলাম। (ওদের উভয়ের ঠোঁটে মুচকি হাসি রয়েই গেছে)

- তো, ধরে নাও, দেশের একটা প্রোজেক্ট থেকে বা সরকারের অফিস থেকে কোটি কোটি টাকা চুরি হয়েছে এবং সেটার জন্য হাজার হাজার মানুষের অন্নেক ক্ষতি হয়েছে, সাংঘাতিক ক্ষতি হয়েছে! তো, অনেক খোঁজাখুঁজি করে প্রমাণ পাওয়া গেলো যে, সেই কোটি কোটি টাকা চুরি করেছে তোমাদের বাপু। মানে আমি শিবলী।

এই কথা শুনেও মেয়ে-দুটো হাসছিলো। বলেছিলো:

- কিন্তু আব্বু তুমি-তো এই কাজ করবা না, তাই না? তুমি কি চুরি করবা?

- ইন্‌শাআল্লাহ্ আমি কখনই চুরি করবো না। কিন্তু এখন ধরে নাও, ঠিক আছে?

- ঠিক আছে, ধরে নিলাম। (তাও দুজনেই হাসছিলো এমন মজার একটা কথা শুনে)

- এখন যেহেতু আমি সেই কোটি কোটি টাকা চুরি করেছি বলে প্রমাণ হয়েছে এবং আমি স্বীকারও করেছি যে, আমিই চুরি করেছি। তোমাদের দায়িত্ব এটার বিচার করা। তোমরা কি করবে? দ্রুত উত্তর দাও।

মাত্র ২-৩ সেকেন্ড চুপ ওরা। তারপর একটু নরম স্বরে প্রায় দু'জনেই একসাথে সোজা বলে দিলো:

- তোমার হাত কেটে দেবো বাপু। (কথাটা বলতেই দুজনের চোখে ছলছল পানি এক সাথে। আমি জানতাম শিশু মনে এতো কঠিন চাপ সৃষ্টি করা ঠিক নয়। কিন্তু কেনো জানি আমি ঐ রাতে প্রশ্নটা না করে থাকতে পারছিলাম না।)

ওদের দুজনের চোখের পানি দেখে আমার চোখ-দুটিও ভিজে আসে বটে কিন্তু ওদের উত্তরে প্রচন্ড খুশি হয়ে আমিও বলেছিলাম ❝আল্‌হাম্‌দুলিল্লাহ্❞ এবং আনন্দে হাসছিলাম।

প্রায় ৫-৬ সেকেন্ড চুপ আমরা তিন জনই। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, ❝তোমার হাত কেটে দেবো বাপু।❞ কথাটা বলতে ওদের কষ্ট হয়েছে, কারণ ওরা আমাকে খুব ভালোবাসে। ওরা হয়তো কল্পনায় ভাবছিলো যে, আমার হাত কাটা হচ্ছে এবং আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। যাই হোক, এক মেয়ে কাঁদতে কাঁদতেই প্রশ্ন করল:

- আচ্ছা বাপু। আল্লাহ্ কি বলে দিয়েছেন যে, চোরের হাত কাটার পর তার চিকিৎসা দেয়া যাবে না?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হলাম! আমিও দ্রুত উত্তর দিলাম, ❝নিশ্চিত জানি না, এই বিষয়ে আল্লাহ্ কি বলেছেন। তবে আমার যেটুকু জ্ঞান আছে তাতে মনে হচ্ছে শাস্তি দেয়ার পর চিকিৎসা দেয়া নিষেধ হবার কথা না।❞

আমার উত্তর শুনে মেয়েদের ঠোঁটে একটু হাসি, যদিও চোখের পানি গালে গড়িয়ে পড়ছে তখনও। বলে:

- তাহলে আব্বু, আমরা একজন তোমার হাত কেটে দেবো আরেকজন সাথে সাথে সেই কাটা হাতটা ধরে ফেলবো যেন মাটিতে পড়ে ময়লা না লাগে। ময়লা লাগলে তো কাটা হাতে ইনফেকশন হয়ে যাবে, তাই না? ওদিকে এম্বুলেন্স রেডি রাখবো আগেই। তারপর তোমাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাবো। ডক্টর সেলাই করে জোড়া লাগিয়ে দেবে। কাটা হাত কি জোড়া লাগানো যায়, আব্বু? যায় তো, তাই না?

খুবি অবাক হয়েছিলাম ৭ বছরের শিশু মনের এমন চিন্তা দেখে। ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমি উল্টা প্রশ্ন করেছিলাম:

- তোমরা কেনো এমনটি করতে চাও আম্মু? খেয়াল করে দেখো, আমি তো অনেক অনেক টাকা চুরি করেছি। হাজার হাজার মানুষের ক্ষতি করেছি। কতো মানুষ কষ্ট পেয়েছে, একবার চিন্তা করে দেখো!

- বাপু, তুমি বললা আমরা বিচারক। তাই তোমার চুরির বিচার করবো কিন্তু আমরা তো তোমার মেয়ে। তোমার কাটা হাত দেখে, তোমার কান্না দেখে আমাদের কষ্ট লাগবে না? বিচারক হয়ে বিচার করবো আর মেয়ে হয়ে তোমাকে চিকিৎসা দেবো। আর তুমিই তো বললা যে, চোরের চিকিৎসা দেয়া ইসলামে নিষেধ নাই। মা-বাবার সেবা করাও তো আমাদের দায়িত্ব, তাই না?

❝বিচারক হয়ে বিচার করবো আর মেয়ে হয়ে তোমাকে চিকিৎসা দেবো।❞ খুব মনে ধরে কথাটা। সেই ২০১২-তে ঘটনার রাতে আনন্দে যেমন করে কেঁদেছিলাম, এই ২০২১-এ এসে সেই ঘটনা লিখতে গিয়ে আবারও কান্না পেয়ে গেলো!

হে আল্লাহ্, সন্তান প্রতিপালনে আমাদের অনেকেরই জ্ঞানের কমতি আছে, পদ্ধতিতেও ভুল-ত্রুটি আছে কিন্তু সামান্য চেষ্টা করছি আমাদের সন্তানদেরকে তোমার পথ দেখাতে। তুমি আল-হাদি, তুমিই সেই পথে আমাদের সকলকে কাছে টেনে নাও। আমাদের সন্তানরা যেনো অন্যায় দেখেও মা-বাবার অন্ধ পক্ষ না নেয়, দল ও স্বজনদের অন্ধ পক্ষ না নেয়, আপনজনদের অন্ধ সাপোর্ট না করে বরং অন্যায়কে যেনো মন থেকে ঘৃণা করে এবং ওরা যেনো দৃঢ়তার সাথে বলতে পারে ❝We All Are Allah's Servant.❞


Post a Comment

Previous Post Next Post