গর্ভকালীন ডায়বেটিস


গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের বিপদ ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছেন প্রায় ১০ শতাংশ মা। চিকিৎসকেরা বলছেন, এই সময় নিয়ম না মানলেই পিছলে পড়ার আশঙ্কা।


নিয়ম মেনে চলার সুফল পাচ্ছেন তনিমা তাশরিন (৩৪)। রাজধানীর মিরপুরের ডিওএইচএসের বাসিন্দা তনিমা বললেন, ‘আমার নিজের ওজন বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তা প্রথম জানতে পারি সন্তান গর্ভধারণের আট সপ্তাহে রক্ত পরীক্ষায়। শুরুতে একটি ইনসুলিন তিনবার খাওয়ার আগে নিতে হতো এবং আরেকটি ইনসুলিন নিতে হতো রাতে খাওয়ার পর। সেই সঙ্গে মেনে চলতে হয়েছে খাবারের সুষম পরিমাণ।’


পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, বছরে দেশে মোট সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটে ২১ লাখ ৯০ হাজার। তবে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সঠিক পরিসংখ্যান নেই।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল বললেন, সঠিক হিসাব না থাকলেও ধারণা করা হয়, ডায়াবেটিস ছিল না কিন্তু গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের শিকার হন প্রায় ১০ শতাংশ মা। খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৫ দশমিক ২ হলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা হয়। এটা নিয়ন্ত্রণের পর মাত্রা থাকতে হবে খালি পেটে ৫ দশমিক ১-এর নিচে এবং খাওয়ার পর ৭-এর নিচে।


ডায়াবেটিস ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক স্ট্যানফোর্ড চিলড্রেনস হেলথের চিকিৎসাবিষয়ক জার্নালে ডায়াবেটিস ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ে বলা হয়েছে। অনেক নারীর গর্ভধারণের আগে ডায়াবেটিস হতে পারে। আবার অনেক নারীর শুধু গর্ভধারণের সময়েই ডায়াবেটিস হতে পারে। গর্ভধারণ করা নারীদের প্রতি ১০০ জনে ৩ থেকে ৯ জনের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে।


জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন বললেন, আগের চেয়ে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গর্ভাবস্থায় হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তাই যাঁদের ডায়াবেটিসের প্রবণতা থাকে, তাঁদের গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। গর্ভের প্রথম ১২ সপ্তাহে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে বলা হয় তাঁদের আগেই ডায়াবেটিস ছিল, কিন্তু তাঁরা জানতেন না। গর্ভকালীন সময়ে এই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে মা ঝুঁকিতে পড়েন। সে ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে সন্তান জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি ৮ শতাংশ বেশি থাকে।


শাহলা খাতুনের পরামর্শ হলো, প্রজননক্ষম প্রত্যেক নারীর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে রাখা জরুরি। ডায়াবেটিসের কথা আগে থেকে জানা থাকলে গর্ভধারণের সময় চিকিৎসা দিতে সুবিধা হয়।


মা ও সন্তানের ঝুঁকি

প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বংশে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে, অধিক ওজন, বয়স ২৮ বছরের বেশি এমন মায়েদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাধারণত ২০ বা ২৪ সপ্তাহের পর যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, তা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। আগে থেকে ডায়াবেটিস রয়েছে এমন মায়েদের গর্ভধারণের সময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে উচ্চ রক্তচাপ থেকে মায়ের একলাম্পশিয়া বা খিঁচুনি হতে পারে। সময়ের আগে প্রসববেদনা শুরু বা অপরিপক্ব সন্তান প্রসবের ঝুঁকি থাকে। মায়ের দেহ থেকে গর্ভের সন্তানের দেহে গর্ভফুলের মাধ্যমে রক্ত চলাচল ব্যাহত হতে পারে। প্রসব-পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে গর্ভের সন্তানের ওজন অনেক কম অথবা অনেক বেশি (ম্যাক্রোসেমিয়া) হতে পারে। জন্মের পর সন্তানের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গিয়ে খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট এবং দেহে তাপমাত্রা বজায় রাখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এতে সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়।


গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের ৫০ শতাংশের সন্তান প্রসবের পর ছয় সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস আর থাকে না। তবে তাঁদের ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।


তনিমা তাশরিন জানালেন, অন্য সব খরচ বাদ দিয়ে গর্ভাবস্থায় তাঁর ৭৬ হাজার টাকার শুধু ইনসুলিনই কিনতে হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটা অনেক বেশি খরচ। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে চলায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ছিল। সন্তান একদম সুস্থ অবস্থায় নির্ধারিত সময়েই জন্ম নিয়েছে।


সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল বললেন, গর্ভকালীন ইনসুলিন ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ নিরাপদ নয়। গর্ভের সন্তানের ওপর ইনসুলিনের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না।


জাতীয় অধ্যাপক শাহলা খাতুন বললেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে গর্ভাবস্থায় মা ও গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়, তা মাকে জানাতে হবে। মাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে যে, তিনি ভালো থাকবেন, গর্ভের সন্তানকে সুস্থ রাখবেন। নজরদারির ক্ষেত্রে সন্তানসম্ভবা মায়ের সেবাদানকারীকেও সচেতন হতে হবে। তাঁর মতে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সদিচ্ছাই শেষ কথা।

Post a Comment

Previous Post Next Post