শীতের শুরুতে শিশুদের সর্দিকাশি ও তার প্রতিকার


শীতের শুরুতে বাতাসে শীতের আমেজ শুরু হয়ে যায় অর্থাৎ ঋতু বদলের আমেজ এবং এই ঋতু বদলের আমেজের সাথে আমাদের শরীরেও এর কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যার প্রকাশ ঘটে ছোট বড় সকলেরই সর্দি কাশী হওয়ার মাধ্যমে। তবে শীশুরাই সকলের আগে আক্রা্ন্ত হয় বেশী।


সর্দিকাশি কোন কঠিন রোগ নয়। আবার রোগও বটে এবং শারীরিকভাবে এক অস্বস্তিকর অবস্হার সৃষ্টি হয়। যদিও শিশুরাই আক্রান্ত হয় বেশী তবু মোটামুটিভাবে বলা যায় যে গড়ে প্রায় প্রতিটি মানুষই বছরে কমপক্ষে দুই থেকে তিনবার সর্দি কাশীতে ভুগে থাকেন।


রোগের কারণ

ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ফলে সর্দিকাশি হয়ে থাকে এবং একবার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে শরীরে যে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরী হয় তা খুবই ক্ষনস্থায়ী। এ কারণেও বারবার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়।


এছাড়া শুধুমাত্র ঋতু পরিবর্তনের কারনেই নয়, অনেক সময় শীতের দিনে হঠাৎ ঠান্ডা লেগে অথবা গরমের সময় ভ্যাপসা গরমে, শরীরে ঘাম বসে গিয়ে শিশুদের সর্দিকাশি হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় শীতের দিনে একটু বেশী ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে বা নাকে ধূলাবালি প্রবেশ করলেও অনেকের নাক দিয়ে পানি ঝরে বা সর্দি কাশী শুরু হয়ে যায়।


এসব ক্ষেত্রে বুঝতে হবে এটি কোন ভাইরাসের কারণে নয় বরং ঐসব পরিবেশের প্রতি এ্যালার্জির কারণে সর্দিকাশী হয়েছে। ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত সর্দিকাশী আবার ছোয়াচে রোগ। সাধারণতঃ একজনের থেকে আর একজনের মাঝে এ রোগ ছড়ায়। করণ এরজীবানু আক্রান্ত ব্যক্তির হাচি কাশী ও থুথুর সাথে বের হয়ে বতাসে অতি ক্ষুদ্র কণা হিসাবে মিশে যায়। তারপর অন্য সুস্হ লোকের শ্বাসের সাথে তাদের নাকে ওশ্বাসনালিতে প্রবেশ করে।


রোগের লক্ষন

সর্দিকাশী হলে নাক দিয়ে স্বচ্ছ পানি বের হতে থাকে, চোখ জ্বালাপোড়া করে। অনেক সময় মাথাব্যাথা হয় সাথে জ্বরও আসতে পারে। এবং সেইসাথে হাচি ওকাশী হয়। অনেক সময় শিশুর বুকে গরগর শব্দ হতে শোনা যায়। এবং সর্দির করণে শিশু ভালভাবে শ্বাস নিতে পারেনা। এবং এ অবস্হায় শিশু অস্বস্তি বোধ করে। ঘুমাতে অসুবিধা হয়। এবং শিশু কান্নাকাটি করে।


সর্দিকাশী রোগের সাথে ইনফ্লুয়েন্জা রোগের কিছুটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তবে ইনফ্লুয়েন্জা রোগ সাধারণতঃ হঠাত করে মাথাব্যাথা ও সর্ব শরীরে ব্যাথা উপসর্গ দিয়ে শুরু হয়। সেইসাথে জ্বর ও বমিও হতে পারে অনেকের আবার শীত করে জ্বর আসে। অনেক ক্ষেত্রে শুকনো কাশীও থাকে। তবে সর্দিজ্বরের মত নাক দিয়ে পানি ঝরা এবং হাচি কাশী দিয়ে শুরু হয়না। এবং ইনফ্লুয়েন্জা রোগোর ভাইরাস সর্দিজ্বরের ভাইরাস থেকে ভিন্ন প্রকৃতির।


চিকিৎসা

শিশুদের সাধারণ বা অল্প সর্দিকাশীতে তেমন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়না। আপনা আপনিই ভাল হয়ে যায়। তবে এই অল্প সর্দিকাশি লক্ষণগুলি খারাপের দিকে যাচ্ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় সাধারণ সর্দিকাশি হবার সাথে secondary infection অথবা দ্বিতীয় দফা জীবানু দ্বারা সংক্রামিত হওয়ার ফলে Bronchitis, Otitismedia ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণ সর্দিকাশি হয়েছে ভেবে দেরী করা ঠিক নয়। অতি সত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা দিয়ে শিশুকে সুস্থ করে তুলতে হবে। শিশুদের ঠান্ডা লাগলে সহজে ছাড়তে চায়না। এসময় ধৈর্য ধরে ডাক্তারের পরামর্শমত ওষুধ খাওয়ান উচিৎ। হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করালে ভাল ফল পাওয়া যায়। যদি জ্বর থাকে তবুও গোসল করালে কোন অসুবিধা হয়না। তবে ভাল করে মাথা গা মুছে দিতে হবে। আর সর্দিতে যদি নাক বন্দ হয়ে যায়, তবে একটা সরু কাঠির আগায় তুলা পেচিয়ে সেটা অলিভ অয়লে ভিজিয়ে নাক পরিষ্কার করে দিিলে শিশু খুব আরাম পায় এবং এতে করে ঘুম ও খাওয়ার অসুবিধা কমে যায়। আর এতেও যদি নাক পরিষ্কার না হয় তবে চিকিৎসকের পরামর্শেNasal decongestant ব্যবহার করে নাক পরিষ্কার করে দেওয়া যায়।


সর্দিকাশিতে শিশুদের জন্য খাবারের কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। শিশু যেসব খাবার খেতে চায় সবই দেওয়া যায়। শুধুমাত্র ঠান্ডা জিনিষ ছাড়া। অনেকে কলা ডিম ইত্যাদি খাবার দিবার ব্যাপারে আপত্তি করেন এসব ভুল ধারণা। একটু গরম, তরল খাবার এসময় শিশু খেয়ে বেশী আরাম বোধ করে,যেমন সুপ হরলিক্স, দুধ ইত্যাদি আর একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে আমাদের চেয়ে শিশুদের শরীরের তপমাত্রা বেশী। তাই। অল্প সর্দিকাশি তেই শিশুদেরকে গরম জামা পরিয়ে রাখলে শিশুরা বরং অস্বস্তি বোধ করে।


প্রতিকার

সর্দিকাশী রোগ একজনের হতে অন্যজনের মাঝে সংক্রমিত হয় এবং শিশুরাই আক্রান্ত হয় বেশী। তাই শিশুদের বেলায় একটু বাড়তি সাবধানতার প্রয়োজন আছে, যেমন সর্দিকাশীতে আক্রান্ত কোন ব্যক্তির হাচি, কাশী ওথুথুর সাথে রোগ জীবানু বের হয়ে যাতে অন্য কারও মাঝে সংক্রমিত হতে না পারে সেজন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে যতোটা সম্ভব শিশুদের কাছ থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।


শিশুর মুখের কাছে হাচি কাশী দেওয়া যাবেনা। এছাড়া মুখের কাছে মুখ আনা এবং চুমু দেওয়াও ঠিক নয়। এছাড়া সর্দিকাশি তে আক্রান্ত ব্যক্তির দৈন্দিন ব্যবহারের জিনিষপত্র গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে সকল রোগজীবানু নষ্ট করে ফেলা উচিৎ যাতে করে জীবানু ছড়াতে না পারে। আর যেসব শিশু দুর্বল ও ঘন ঘন অসুখে ভোগে তাদের অবশ্যই আলাদা ঘরে রাখতে হবে এবং তাদের শরীরের প্রতি বাড়তি দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ এইসব শিশুর বারবার ঠান্ডা লেগে সর্দিকাশী হবার প্রবনতা থাকে। আর মনে রাখতে হবে শিশুদের সর্দিকাশী বা ঠান্ডা লাগলে নিজেরা বা দোকানির পরামরর্শে ওষুধের দোকান থেকে cough syrup or Antihistamin syrup কিনে এনে খাওয়ান ঠিক নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনরকম ওষুধই শিশুদেরকে দেওয়া ঠিক নয়। 


আর দরজা জানালা বন্দ করে অস্বাস্থকর পরিবেশেও শিশুদের রাখা ঠিক নয়।ঠিকমত আলোবাতাস খেলা করে এমন ঘরে শিশুদেরকে রাখা উচিৎ। শিশুর ঘরের জানালা দরজা যতটা সম্ভব খোলা রাখা উচিৎ। সকালের রোদটা শিশুর গায়ে লাগাতে পারলে খুব উপকার হয়। আর সর্দিকাশি র হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করার জন্য তার দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। আর সেকারণে শিশুকে সুষম খাবার খেতে দিতে হবে। শরীরের প্রয়োজন অনুপাতে শিশুকে কার্বোহাইড্রেট , প্রোটিন ফ্যাট এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খওয়াতে হবে। আর সাথে প্রচুর পরিমানে পানি খাওয়ানোর অভ্যাস করাতে হবে। আর এভাবে শিশুর প্রতি যত্নবান গলে ধীরে ধীরে শিশুর শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে এবং ঘন ঘন আর সর্দি , কাশী জ্বরে আক্রান্ত হবেনা।


লিখেছেন: Dr. Sujan C Paul

Post a Comment

Previous Post Next Post