বাচ্চাদের নিউমোনিয়া ট্রিটমেন্ট প্রোটকল

 


যেকোন মৃত্যু কোন না কোন সংবাদ দেয়। সে সংবাদ সবচেয়ে বেশি বোঝে সেই মানুষ, যারা বা যে তাকে সবচেয়ে ভালবাসত, বা সে যাকে সবচেয়ে ভালবাসত। বা উল্টাও হতে পারে।


যাহোক, কথা সেটা না। ক'দিন ধরে মনে হচ্ছে শুধু ফারসীম ভায়ের মেয়েটার কথা। (Farseem Mannan Mohammedy) মধু মারা গেছে ৩/৪ দিন হলো। তার লাশবাহী গাড়ীর ছবিটা, তার মায়ের কান্নার ছবি আমি ঘুমে থাকলেও মাথার ভেতর ধাক্কা দিচ্ছে বারবার। ফারসীম দম্পতিকে সহানুভুতি জানানোর কোন ভাষা নেই আমার। ফেসবুকে খবরটা দেখে স্তব্ধ লাগছে সেদিন হতে- ছোট্ট নিষ্পাপ মুখ চলে গেলে নিজেকে পর্যন্ত অপরাধী লাগে, সে না হোক আমার কেউ।


চিন্তা হচ্ছে ছোট ছোট কত বাচ্চা দেশে কেমন চিকিৎসা পায়, কেন দরকার হয় এই বয়সে তাদের চিকিৎসা, কেন পায় না ভাল চিকিৎসা ইত্যাদি নানা প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার মেয়েটাকে নিয়ে ক'দিন বাদে আমি দেশে যাব। সে চিন্তাও হচ্ছে।


নিউমোনিয়াতে আজকাল তো মারা যাবার দৃষ্টান্ত কম। কেননা ভাল ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন আছে। এন্টিবায়োটিক আছে। তবু সব কিছু বোঝা, জানার লোক কতটুকু আছে? আমরা গার্ডিয়ানেরাই বা কতটুকু সতর্ক এসব ব্যাপারে। তাঔ আমার একটু জ্ঞান শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে এসব ব্যাপারে।


নিউমোনিয়ার আকার/প্রকারঃ অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি বিভিন্ন ধরনের নিউমোনিয়ার বিভিন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস এসব বিভিন্ন ধরনের নিউমোনিয়া আছে। কমিউনিটি একুইর্ড নিউমোনিয়া বা হস্পিটাল একুইর্ড নিউমোনিয়া প্রধানত এ দুভাগে বিভক্ত নিউমোনিয়া। কোন কারনে হসপিটালে বেশ কিছুদিন থাকলে অনেকে হাস্পাতাল সোর্স হতে নিউমোনিয়া ব্যাক্টেরিয়ায় ইনফেক্টেড হয়। একে নসোকমিয়াল নিউমোনিয়াও বলে। এটা হোল নিউমোনিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক চেহারা। কোন মানুষ হাস্পাতাল থেকে ইনফেকশন হলে বেশ কতকদিন পরে এর সিম্পটম দেখা যায়। হাস্পাতালে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায়, জার্ম বেশি, ইনফেকশনের চান্স বেশী । লেজিওনেলা নামক ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা সংক্রমন হলে বুঝতে হবে এটা হাস্পাতাল হতে সংক্রমিত। কমিউনিটিতে সাধারনত এ ব্যক্টেরিয়ার সংক্রমন হয় না। এর ট্রিট্মেন্ট সাধারন নিউমোনিয়া হতে আলাদা।


আর কমিউনিটি একুইর্ড নিউমোনিয়া ভাইরাস হতে শুরু করে মারাত্মক বিভিন্ন ধরনের ব্যাক্টেরিয়া বা জার্ম এর সংক্রমনের কারনে হয়। বিভিন্ন ধরনের জার্ম দিয়ে সংক্রমণ হয় বলে কমিউনিটি একুইর্ড নিউমোনিয়ার ডায়াগ্নোসিস কঠিন। সাধারন হতে ভয়াভহ পর্যন্ত একটা বড় রেঞ্জ কভার করে এই কমিউনিটি একুইর্ড নিউমোনিয়া। একটা গবেষনা হতে দেখা যায়, বিশেষ করে ৩/৪ বছরের উপরের বাচ্চাদের কমিউনিটি একুওর্ড নিউমোনিয়া ডায়াগ্নোসিস কঠিন হয়। কেন ? সেটা অপ্রাসাঙ্গিক হতে পারে বলা।


চিকিৎসাঃ

যে কোন ব্যাক্টেরিয়াল নিউমোনিয়া সঙ্গক্রমন ধরা পড়ার ৪৮ ঘন্টার ভেতর চিকিৎসা না দিলে তা ভয়াভহ পর্যায়ে চলে যেতে পারে খুব কম সময়ের ভেতর। কেননা, নিউমোনিয়াতে লাঙ্গের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এল্ভিউলি-গুলো ব্যাক্টেরিয়া আটকে থাকে, প্রচুর পুজ, বা মিউকাস জমে যায়। লাঙ্গে রক্ত চলাচলে সমস্যা হয়। শরীরের নিজস্ব ম্যাকানিজমে লাঙ্গে তখন প্রচুর পরিমান রক্ত এসে লাং লাল বর্ন ধারন করে। যাহোক, এক্স রে, পি সি আর এসব হোল এর ডায়াগ্নোসিস এর জন্য সবচেয়ে ভাল উপায়। পি সি আর ছাড়া অনেক সময় ছোট বাচ্চাদের ইনফেকশনের ধরন বা মাত্রা বোঝা যায় না। যহোক, চিকিৎসা কি?


হস্পিটাল একুইর্ড নিউমোনিয়া হলে চিকিৎসা ভিন্ন। ব্যায়বহুল চিকিৎসা। হস্পিটালাইজেশন একেবারেই অত্যবশ্যক ৪৮ ঘন্টার ভেতর। অত্যন্ত লেটেস্ট এন্টিবায়োটিক, যেমন, মেরেপেনেম নাকম এন্টিবায়টিক দেয়। অথবা পিপারসিলিন , সাথে টেজোব্যাক্টাম, অথবা এমক্সিসিলিন সাথে ক্লাভিনিউলুক এসিড এসব। এই যে সাথে একটা এক্সট্রা দেয় কেন? এমক্সিসিলিন বা পিপারসিলিন এর রিংগুলো ভেঙ্গে গেলে আর কাজ হয় না। সে জন্য এগুলো দিতে হয়। মেরেওপেনেম খুব ভাল ঔষুধ হলেও, খুব এক্সপেন্সিভ এন্টিবায়োটিক।


এমোক্সিসিলিন (ওরাল) হোল সাধারন বা কমিউনিটি একুর্ড নিউমোনিয়ার প্রথম ঔষুধ। এই পর্যায়েও রুগিকে বাসায় রেখে ট্রিট্মেন্ট দেয়া যায়। কিন্তু, নিউমোনিয়া কন্ট্রোলে না রাখতে পারলে হসপিটালে এডমিশন আবশ্যক। ওরাল ডোজে কাজ না হলে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া, এন্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স, রোগের উন্নতি হচ্ছে কিনা এবং সুপার ইনফেকশন পর্যবেক্ষনে রাখতে হাস্পাতালে নেয়াই ভাল। রেজিস্ট্যান্স চেক করেই অবশ্য ডাক্তারেরা এসব এন্টিবায়োটিক দিয়ে থাকে।কেননা, রেজিস্ট্যান্স হয়ে যাওয়া মানে ট্রিট্মেন্ট না করার মত ব্যাপার।


তবে, নিউমোনিয়াতে বা এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিতসায় এন্টিবায়োটিক-এর সুপার ইনফেকশন খুব মারাত্মক আর একটা ব্যাপার। এর মানে যখন আপনি এন্টিবায়োটিক খাচ্ছেন, তখন বুঝতে হবে দু'টো জিনিস - একটা, রেজিস্ট্যান্স টেস্ট করা হয়েছে কিনা। অন্য আর একটা সুপার ইনফেকশন ডেভেলপ করছে কিনা । সুপার ইনফেক্তশন টা এত মারাত্মক যে, এই কারনেই রুগী মারা যেতে পারে।


এন্টিবায়োটিক সাইড ইফেক্ট/ সুপার ইনফেকশন কি ও চিকিৎসা কি?

স্যুপার ইনফেকশনের নানা রূপ আছে। সুপার ইনফেকশন হলে পেটের ভেতর ভাল ব্যাক্টেরিয়াগুলো মরে যেয়ে ছত্রাক এর গ্রোথ বেড়ে যায়। এত দ্রুত ছত্রাক জাতীয় নিম্নমানের জীবানুর (ক্লিস্ট্রিডিয়াম ডেফিসিলি) সংক্রমনে সিউডোমেম্ব্রেনাস কলিটিস বা মেগা কোলন নামের এই সুপার ইনফেকশন হয়। এটাই মৃতুর কারন হতে পারে। এমোক্সিসিলিন , যেটা নিউমোনিয়ার ওষুধ, এটা সহ কয়েকটা এন্টিবায়োটিকের মারাত্মক সাইড ইফেক্ট এই সুপার ইনফেকশন।


সুপার ইনফেকশনের সিম্পটম টাইফয়েড এর মত। পেটে অসুখ, রক্ত মিশ্রিত পায়খানা, বমি ইত্যাদি। কিন্তু, টায়ফয়েড না। টাইফয়েডের ব্যাক্টেরিয়ার নাম সালমোনেলা টাইফি। সুপার ইনফেকশনের জীবানুর নাম ক্লস্ট্রিডিয়াম ডেফিসিলি। ডাক্তারেরা অনেক সময় ভুল করে , যাদের জ্ঞান ট্যান একটু কম তারা ভুল করে বলে টাইফয়েড। সুপার ইনফেকশনের ঔষুধ হোল মেট্রোনিডাজল । মেট্রোনিডাজলে কাজ না হলে ভ্যাঙ্কোমাইসিন দিতে হবে।


সুপার ইনফেকশনের সঠিক চিকিৎসা না হলে চরম পর্যায়ে শরীরের রক্তে ছত্রাক ইনফেকশন বেড়ে যায় (যারে বলে সেপসিস) তবে নিউমোনিয়া বা টাইফয়েড এর রুগীকে বাচানো প্রায় যায় না বললেই চলে। ওল্প সময়ের ভেতর রুগী মারা যেতে পারে। কারন, রুগীর রক্ত যখন ইনফেক্টেড হয় , তখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা চলে যায়। সমস্ত শরীরে ইনফেকশন ছড়ায়ে পড়ে। সেপসিস এর কোন ট্রিট্মেন্ট আছে কিনা আমার আর জানা নেই।


৩/৪ বছর পার হয়েছে এমন বাচ্চাদের নিউমোনিয়া বোঝা , ডায়াগ্নোসিস একটু কঠিন বলেই গবেষকেরা বলছেন। আরো বিশেষ করে আমাদের মত দেশে , যেখানে অসংখ্য চেনা , অচেনা জীবানু। বাবা মায়েরা যেন সতর্ক থাকে, এই ধরনের নিউমোনিয়া, এজমা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া টাইপের অসুখ , বিসুখের ব্যাপারে। সময় মত ডাক্তার দেখান।


এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্ক থাকুন। শিক্ষিত মানুষেরা যারা পড়তে পারেন, তারা বেশি বেশি পড়ুন রোগ , ঔষুধ এসবের ব্যাপারে। যখন সময় পাবেন তখনই পড়ুন। আজকাল কিন্তু জ্ঞানের অভাব নেই ইন্টারনেট -এর সুবাদে। ডাক্তারের সাথে খোলা মেলা কথা বলুন । ডাক্তারদেরকে ভুল ভালের ব্যাপারে সতর্ক করুন, নিজে জ্ঞানার্জন করে তাদেরকে সাহায্য করুন। ১৯৭০ সালে আলমা আটা সম্মেলনের মাধ্যমে রুগীদের উপর ডাক্তারদের একচ্ছত্র অধিকার হরন করেছে উন্নত বিশ্বের মানুষ। এতে যে সবাই ডাক্তার হয়ে গেছে তা না। বরং ডাক্তার ও রুগী বা অভিভাবক সবার সচেতেনতা বেড়েছে রোগের ব্যাপারে। কিছুটা কাজ তো হয়েছেই। বাংলাদেশে অনেক মুর্খ টাইপের ডাক্তারের আবির্ভাব হয়েছে। তাদেরকে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষিত করে তোলা যেত যদি সরকার তাদের মান নিয়ন্ত্রনে যথাযথ ভুমিকা রাখতে পারত। এখন জনগনের উচিত তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলা।


যাহোক, এসব কোন কিছুর কারনে ফারসীম ভায়ের মেয়েটা মধু, এত কম সময়ের ভেতর মারা গেল কিনা আমি জানি না। এত সুদুরে বসে কিছুই বোঝা যায় না, অনুমান করা যায় মাত্র।


এতটুকুন লিখলাম শুধু মধুকে স্মরন করে। এত অল্প বয়সে কোন সংবাদ দিয়ে মধু চলে গেল ফারসীম ভাইদের ছেড়ে চিরতরে আমি জানি না। মধুর মৃত্যু এই সুদুরে বসে আমাকে এইটুকু লিখতে বলল বলে মনে হোল। মধুকে আমি দেখি নি কখনো বাস্তবে। প্রতিটা মানুষই তো ভালবাসার মানুষ আমাদের এই বয়সে। ফেসবুকে আসলেই মধুর পোস্ট দেখলে কেমন যেন বুকের ভেতর শূন্যতা জেগে উঠছে একরাশ। দেশের এই ছোট্ট ছোট্ট আম্মুরা, তোমরা ভাল থাকো, যে যেখানে থাকো, খুব ভাল থেকো-- এপারে , ওপারে সর্বত্র।


রেফারেন্সঃ অস্ট্রেলীয়ান মেডিসিনস হ্যান্ডবুক ও ইন্টারনেট


লিখেছেন: মাসুমা পারভীন

Post a Comment

أحدث أقدم